তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় মাথা হেঁট করলেন না
…………………………………………………………………………………
রবীন্দ্র-শরৎ-নজরুল উত্তর যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক তিনি। গণদেবতা, হাঁসুলি বাঁকের উপকথা, আরোগ্য-নিকেতনের মত উপন্যাসের কথা আজ ক’জন পড়ে! কিন্তু এই অসামান্য সৃষ্টিগুলিকে বাদ দিয়ে বাংলা সাহিত্য হয় না। তিনি যেমন ছিলেন একজন গুণী সাহিত্যিক, তেমনই ব্যক্তিগত জীবনেও তিনি উঁচু মূল্যবোধের সাক্ষ্য রেখে গিয়েছেন, যা অনুসরণীয়। তারই স্মৃতিচারণা।
……………………………………………………………………………………
রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “সত্যমূল্য না দিয়েই সাহিত্যের খ্যাতি করা চুরি / ভালো নয় ভালো নয়, নকল সে সৌখিন মজদুরি।“ সাহিত্যে যা বলব, নিজের জীবনের সঙ্গে তার মিল থাকবে না? তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় তাই কোনো কিছুর পরোয়া না করেই জেলে চলে গেলেন। তিনি নিজেই একদিন "গণদেবতা"-র নায়ক হয়ে গেলেন! সেইসময় স্বাধীনতা আন্দোলনের ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। শ্লোগান উঠেছে - ‘ইংরেজ তুমি ভারত ছাড়।‘ তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ও সক্রিয়ভাবে সেই “ভারত ছাড়ো আন্দোলনে” যুক্ত হয়ে পড়লেন। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের তখন লেখক হিসাবে নামডাক হয়েছে। তাঁকে অনেক সাহিত্যিক বারণ করছেন, প্রত্যক্ষ আন্দোলনে জড়িয়ে না পড়তে। বিখ্যাত সাহিত্যিক শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় ছিলেন তারাশঙ্করের বন্ধু। তিনিও তাঁকে বারবার সাবধান করছেন, এভাবে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ো না। ভুল করছো। বিপদে পড়বে। আমরা লেখক। এসব আমাদের কাজ নয়।
তারাশঙ্কর হেসে বললেন, দ্যাখো আমি জীবন আর সাহিত্যকে আলাদা করে দেখি না। গল্প - উপন্যাসে ভাল ভাল কথা বলবো, কিন্তু নিজের জীবনের ক্ষেত্রে সেটা মানবো না? তা কী করে সম্ভব?
অবশেষে তারাশঙ্করকে একদিন লাভপুরের এক গোপন ডেরা থেকে পুলিশ গ্রেপ্তার করল।
বিচার হবে। কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে তারাশঙ্কর। এস ডি ও ছিলেন মণি সেন। এস ডি ও তারাশঙ্করের খুব ঘনিষ্ট বন্ধু ছিলেন। এস ডি ও তারাশঙ্করকে বারবার অনুরোধ করলেন, আপনি একবার শুধু বলুন, আপনি রাজনীতি ছেড়ে দেবেন। এসব নোংরা কাজ আর করবেন না। তাহলে আমি আপনাকে ছেড়ে দেবো।
তারাশঙ্কর বললেন, দেশকে আমি ভালবাসি। আপনি একে নোংরা কাজ বলছেন! ছিঃ!
তারাশঙ্কর মাথা হেঁট করলেন না। বিচারে এক বছরের জেল হ'লো।
জেল থেকে একদিন মাথা উঁচু করে বেরিয়ে এলেন তারাশঙ্কর। "জ্ঞানপীঠ" পুরস্কারে সম্মানিত উপন্যাস "গণদেবতা"-র অন্যতম নায়ক দেবু পণ্ডিতের মত। আজকাল এরকম মেরুদণ্ড সোজা রাখা সাহিত্যিক কোথায়?