……………………………………………………………………………………
আজকের প্রজন্ম তাঁর নাম জানে না। কিন্তু একদিন তিনিই একা পাড়ি দিয়েছিলেন বায়ু-বিহীন, নির্জন পিচ-কালো মহাকাশে। বাবা ছিলেন ট্রাক্টর-চালক; মা ছিলেন বস্ত্র-কারখানার শ্রমিক। তাদের মেয়ে ভ্যালেন্টিনা তেরেসকোভা হলেন মহাকাশ-বিজয়িনী প্রথম নারী। তেরেসকোভার সাফল্য ভারতের মানুষকেও এতটাই প্রভাবিত করেছিল যে বাংলা চলচিত্রেও তাঁর নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে উল্লেখিত হয়েছে। ৬ মার্চ ছিল তাঁর জন্মদিন। তাঁকে নিয়ে একটি ছোট প্রতিবেদন।
……………………………………………………………………………………
ভ্যালেন্টিনা ভ্লাদিমিরোভনা তেরেসকোভা পৃথিবীর প্রথম মহিলা মহাকাশচারী। মহাকাশ অভিযান করা ছাড়াও তিনি একজন প্রযুক্তিবিদ বা ইঞ্জিনীয়ার ছিলেন এবং পরবর্তীকালে রাশিয়ান স্টেট ডুমার সদস্যও হয়েছিলেন। তিনিই মহাশূন্য থেকে ঘুরে আসা আজ পর্যন্ত কনিষ্ঠতম মহিলা। ১৯৬৩ সালের ১৬ জুন ভোস্টক-৬ এ চেপে তেরেসকোভা একাই মহাকাশে গিয়েছিলেন। তেরেসকোভার মহাকাশ-যান ভোস্টক পৃথিবীকে প্রায় ৪৮ বার প্রদক্ষিণ করেছিল। প্রায় তিন দিন মহাশূন্যে কাটিয়েছিলেন তিনি।
তেরেসকোভা মধ্য রাশিয়ার ইয়ারোস্লাভ ওব্লাস্টের অধীনে তুতায়েভস্কি জেলার মাসলেনিকোভো গ্রামে ১৯৩৭ সালের ৬ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। নভেম্বর বিপ্লবের পর তাঁর বাবা-মা বেলারুশ থেকে অভিবাসিত হয়ে রাশিয়াতে আসেন। তেরেসকোভার বাবা ছিলেন একজন ট্রাক্টরচালক এবং মা বস্ত্রশিল্প কারখানার শ্রমিক। যুদ্ধের কারণে একটু দেরীতে দশ বছর বয়সে ১৯৪৫ সালে তেরেসকোভা বিদ্যালয়ে যেতে শুরু করেন। ১৯৫৩ সালে বিদ্যালয় ত্যাগ করে দূরশিক্ষণ পাঠ্যক্রমে শিক্ষালাভ করেন। ১৭ বছরে তিনি স্নাতক হন। সোভিয়েত মহাকাশ প্রোগ্রামের জন্য নির্বাচিত হবার আগে তেরেসকোভা একটি টায়ার কারখানায় কাজ শুরু করেন; পরে তিনি একটি টেক্সটাইল কারখানার প্রকৌশলী হন। শৈশবকালে তিনি প্যারাসুটের মাধ্যমে আকাশে চড়ার স্বপ্ন দেখতেন। ভারতের মতো একটি পুঁজিবাদী দেশে সেই স্বপ্ন হয়ত অধরাই থেকে যেত। একটি শ্রমিকের পরিবারের মেয়ে আকাশে উড়বে! বিমান চালাবে! ভাবাই যায় না। অত অর্থ কোথায়? সময়ই বা কই? কিন্তু সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন সকল প্রতিভাকে বিকাশের সুযোগ দিয়েছিল। তেরেসকোভা কাজের ফাঁকে ফাঁকে স্থানীয় বিমানচালনা ক্লাবে স্কাইডাইভিং-এ প্রশিক্ষণ নেন। ২২ বছর বয়সে ২১শে মে, ১৯৫৯ সালে তিনি প্রথম স্কাই-ডাইভ করেন। ততদিনে অবশ্য সোভিয়েত ইউনিয়নে্র মহাকাশ অভিযান শুরু হয়ে গিয়েছে। ১৯৫৭ সালের ৪ অক্টোবর সমগ্র দুনিয়াকে বিস্মিত করে মহাকাশে পাড়ি দেয় স্পুটনিক। তারপর একে একে মহাকাশে নন-ম্যানড মিশন চালায় বিশ্বের প্রথম সমাজতান্ত্রিক দেশটি।
স্কাই-ডাইভিং-এ অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান তেরেস্কোভাকে নভোচারী হিসেবে যোগ দিতে ব্যাপকভাবে সহযোগিতা করেছিল। তিনি কসমোনাট কর্পসের অংশ হিসাবে সোভিয়েত বিমান বাহিনীতে যোগদান করেন এবং প্রশিক্ষণ শেষ করে অফিসার হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করেন। ১৯৫৯ সালে মহিলা মহাবিদ্যালয়ের প্রথম দলটি মহাকাশ-কর্মসূচী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেও, তেরেসকোভা মহাকাশচারী শিক্ষার্থী হিসাবে মহাকাশ প্রোগ্রামে থেকে যান। পরে তিনি ঝুকভস্কি এয়ার ফোর্স ইঞ্জিনিয়ারিং একাডেমি থেকে স্নাতক হন এবং মহাকাশে যাত্রার জন্য যোগ্যতা অর্জন করেন। ৪০০ জনের মধ্য থেকে নির্বাচিত হন তেরেসকোভা। এরপর চলে ১৮ মাসের কঠোর প্রশিক্ষণ।
তারপর এল সেই ঐতিহাসিক দিন। ১৬ জুন, ১৯৬৩। ভোস্টক-৬ মহাকাশ-যানে করে বৈকানুর উৎক্ষেপণ-কেন্দ্র থেকে তিনি একাই পাড়ি দিলেন মহাকাশে। ৭০ ঘন্টা তিনি মহাকাশে কাটান। মহাকাশে অবশ্য তখন তিনি একা ছিলেন না। ১৪ জুন (১৯৬৩ খ্রীঃ) ভোস্টক-৫-এ করে মহাকাশে পৌঁছেছেন ভ্যালেরি ভাইকোভস্কি। দুটি ভিন্ন পথে তাঁরা রওনা হলেও দূরত্ব কমিয়ে পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মাত্র তিন কিলোমিটার ব্যবধানে চলে আসেন। তেরেসকোভা মহাকাশে ভাইকোভস্কির সঙ্গে বেতার-মাধ্যমে যোগাযোগ করেন এবং ‘সীগাল’ নামে কথাবার্তা চালান। মহাকাশ-যান থেকে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্টের সঙ্গেও কথা বলেন। সোভিয়েত টেলিভিশন ক্যাপসুলে করে তেরেসকোভার মহাকাশ অভিযান সম্প্রসারিত করেছিল।
প্রসঙ্গতঃ পৃথিবীর প্রথম মহাকাশচারী ইউরি গ্যাগারিনও ছিলেন একজন সোভিয়েত নাগরিক। ১৯৬১ সালের ১২ এপ্রিল তিনি মহাকাশে পাড়ি দিয়েছিলেন এবং পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করেছিলেন। গ্যাগারিনের দুই বছর পরে মহাকাশে যান ভ্যালেন্টিনা তেরেসকোভা। দ্বিতীয় মহিলা মহাকাশচারীও একজন সোভিয়েত নাগরিক ছিলেন। তাঁর নাম স্বেতলানা সাভিৎস্কায়া। তেরেসকোভার ১৯ বছর পর ১৯৮২ সালে স্বেতলানা মহাকাশে যান। তিনি দুই বার মহাকাশ অভিযান করেন এবং বিশ্বের প্রথম মহিলা হিসেবে স্পেসওয়াক করেন।
তবে তেরেসকোভা ১৯৬৩ সালের পরে আর কখনো মহাকাশে যাননি। ১৯৯৭ সালে তিনি মেজর জেনারেল পদমর্যাদা অর্জন করে বিমান বাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করেন। মহাকাশ অভিযানের সাথে সাথে ১৯৬১ সালে তিনি স্থানীয় কমসোমল বা যুব কমিউনিস্ট লীগে যোগ দেন। পরবর্তীকালে সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন। সোভিয়েত নারী সমিতির পরিচালক নিযুক্ত হন ১৯৬৮ সালে। তেরেসকোভা ১৯৬৬ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত সুপ্রিম সোভিয়েতের প্রেসিডিয়াম সদস্যসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দফতর নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির বিশিষ্ট সদস্য ছিলেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরে তিনি ১৯৯৫ ও ২০০৩ সালে দুবার জাতীয় রাজ্য ডুমার কাছে নির্বাচনে পরাজিত হয়েছিলেন। পরবর্তীতে ২০০৮ সালে তার আঞ্চলিক সংসদ, ইয়ারোস্লাভল ওব্লাস্ট ডুমার হয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন তেরেসকোভা। ২০১১ সালে তিনি সংযুক্ত রাশিয়া দলের সদস্য হিসাবে জাতীয় রাজ্য ডুমায় নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং ২০১৬ ও ২০২১ সালে পুনরায় নির্বাচিত হয়েছিলেন।
ব্যক্তিগত জীবনে ১৯৬৩ সালের ৩ নভেম্বর আন্দ্রিয়ান জি. নিকোলায়েভ নামের একজন নভোচারীকে বিয়ে করেন তেরেসকোভা। তাঁদের একটি কন্যা আছে। তেরেশকোভা "সোভিয়েত ইউনিয়নের বীর" উপাধি এবং দুবার ‘অর্ডার অব লেনিন’ পুরস্কারেও ভূষিত হন। ইউরি গ্যাগারিন ১৯৬৮ সালের ২৭ মার্চ মাত্র ৩৪ বছর বয়সে একটি বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হলেও এই অসামান্যা মহিলা ৮৭ বছর বয়সে আজও জীবিত আছেন।
পরবর্তী সময়ে আমেরিকান মহাকাশ সংস্থা নাসা অনেক মহাকাশ অভিযান করলেও একথা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে জার আমলের দুর্দশাগ্রস্ত শত শতাব্দী পিছিয়ে থাকা রাশিয়া ১৯১৭ সালে বিপ্লবের পর জ্ঞানে-বিজ্ঞানে-সাহিত্যে-শিল্পে-ক্রীড়াক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতি লাভ করে। সোভিয়েত ইউনিয়নই প্রথম মহাকাশ অভিযান করে, মানুষ পাঠায়। সোভিয়েত ইউনিয়নে নারীরা শিক্ষায় ও মর্যাদায় কোন স্তরে উন্নীত হয়েছিল তার উল্লেখযোগ্য প্রমাণ হলেন ভ্যালেন্টিনা তেরেসকোভা।