CATEGORY state:

Card image cap

সন্দেশখালি ও শেখ শাহজাহান : দায় কার?

শেখ শাহজাহান নামটি এখন পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সিংহভাগ মানুষের পরিচিত। তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা, জেলা পরিষদের কর্মাধ্যক্ষ শেখ শাহজাহান সন্দেশখালির বেতাজ বাদশা বলে পরিচিত ছিলেন। রেশন দুর্নীতি তদন্তে ২৫ জানুয়ারী ইডি সরবেড়িয়ায় শাহজাহানের সুবিশাল বাড়িতে পৌঁছালে তাদের অফিসারদের কেবল বাধা দেওয়া নয়, শারীরিক ভাবেও নিগৃহীত করা হয়। এরপর থেকেই তিনি নিখোঁজ হয়ে যান। পুলিস কয়েক মাস ধরে তাকে খুঁজে পায় না। কিন্তু মানুষ বিশেষতঃ মহিলারা সন্দেশখালির বিভিন্ন গ্রামে শেখ শাহজাহানের বাহিনীর বিরুদ্ধে পথে নামলে রাজ্য সরকারের পুলিস তাকে গ্রেপ্তার করতে বাধ্য হয়। তৃণমূল কংগ্রেসও তাকে অপসারণ করে দায় ঝেড়ে ফেলতে চায়। কিন্তু শেখ শাহজাহান ও তার সঙ্গী শিবু হাজরা, উত্তম সর্দারদের এই অপরাধের বাড়বাড়ন্ত কেন?

এই রাজ্যে যখন সিপিএম-নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট সরকার ছিল, তখন শাহজাহান শাসক দলের সাথেই যুক্ত ছিল। আজ সিপিএম নেতারা যাই বলুন, সেই সময় থেকেই তার যাত্রা শুরু হয়েছিল। শাসন থেকে হাড়োয়া, মিনাখাঁ, বাসন্তী, ক্যানিং হয়ে সন্দেশখালি, বসিরহাট, হাসনাবাদ, হিঙ্গলগঞ্জের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে কৃষি জমি দখল করে নদীর নোনা জল ঢুকিয়ে মাছের ভেড়ি করার উদ্যোগ সিপিএম-সরকারই নেয়। এতে প্রচুর কাঁচা টাকা উপার্জন হতে থাকে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই এই অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক চরিত্রের পরিবর্তন হতে থাকে। একদল মানুষ যেমন ফুলে-ফেঁপে ওঠে, তেমনই কৃষি জমির অভাব সৃষ্টি হওয়ায় বিপুল সংখ্যক মানুষ কাজের খোঁজে ভিন রাজ্যে, এমনকি বিদেশেও পাড়ি দেয়। বাড়ির মেয়েরা মিন ধরার জন্য সকাল থেকে হাঁড়ি আর জাল নিয়ে খালে নেমে পড়তে বাধ্য হয়। ভেড়ি নিয়ে শুরু হয় মারামারি, কাটাকাটি। গড়ে ওঠে দুষ্কৃতী বাহিনী। সিপিএম পরিচালিত গ্যাংয়ের দাপটে মানুষ মুখে কুলুপ আঁটে। নির্বাচন প্রহসনে পরিণত হয়। ক্যানিং পূর্বে রেজ্জাক মোল্লা, বাসন্তীতে সুভাষ নস্কর, সন্দেশখালিতে অবনী রায়েরা বিপুল ভোটে জিততে থাকে। সওকাত মোল্লা, শেখ শাহজাহানেরা এলাকার ত্রাস হয়ে ওঠে। পুলিস সরকারি দলের অঙ্গুলিহেলনেই চলত বলে অভিযোগ। কেবল টিএমসি, কংগ্রেস বা এসইউসিআই নয়, বামফ্রন্টের অন্যতম শরিক আরএসপি-র উপরেও আক্রমণ নেমে আসে। বাসন্তীর চরাবিদ্যায় আরএসপি নেতা ও রাজ্যের তৎকালীন সেচমন্ত্রী সুভাষ নস্করের ভাতৃবধু সহ চার জনকে একই দিনে হত্যা করা হয়। মন্ত্রীত্ব রক্ষার জন্য আরএসপিকে কিল খেয়ে হজম করতে হয়।

রাজ্যে পট-পরিবর্তন হলে তৃণমূল যেন সিপিএমের দেখানো পথ ধরে চলা শুরু করে। ২০১৩ সালের মধ্যে সওকাত মোল্লা, শেখ শাহজাহানেরা টিএমসিতে যোগ দেয়। সওকাত হন দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার তৃণমূল যুব কংগ্রেসের সভাপতি। শেখ শাহজাহান হন যুব তৃণমূলের ব্লক প্রধান। ভেড়ি দখল, পোল্ট্রি দখল, জমি দখল, আইনী এবং বেআইনী মদের ব্যবসা, ফেরীঘাটের ইজারা, বাজার দখল ও হোটেল বানানো চলতে থাকে অবাধে। বর্তমানে রাজ্যের বিরোধী দলনেতা এবং তৎকালীন তৃণমূল যুব কংগ্রেসের রাজ্য সভাপতি শুভেন্দু অধিকারীর স্নেহচ্ছায়াতেও লালিত-পালিত হয়েছেন শেখ শাহজাহান।

আজ সিপিএম এবং বিজেপি শেখ শাহজাহানের বিরুদ্ধে গলা চড়িয়েছে। কিন্তু শাহজাহানের উত্থানে তাদের ভূমিকা কি অস্বীকার করা যায়? আর তৃণমূল কংগ্রেস যতই ‘সামান্য ঘটনা’, ‘আইন আইনের পথে চলবে’ বলুক, কিংবা তড়িঘড়ি ‘অভিযোগ গ্রহণ কেন্দ্র’ তৈরী করে বিক্ষোভ ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করুক না কেন, শেখ শাহজাহানদের অপরাধের দায়িত্ব কি তাদেরও নয়?

বিজেপি এখানে ‘হিন্দু মহিলাদের’ উপর হামলা করা হয়েছে বলে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরী করতে চাইছে। কিন্তু অভিযোগ কি কেবল শেখ শাহজাহানের বিরুদ্ধে? শিবু হাজরা, উত্তম সর্দার সহ অভিযুক্তদের অধিকাংশেরই তো ধর্মীয় পরিচয় হিন্দু। ‘সন্দেশখালির মুখ’ রেখা পাত্রকে এইবারে লোকসভা ভোটে দাঁড় করিয়েছে বিজেপি। কিন্তু, দেশের মানুষ সাক্ষী মালিক, ভিনেশ ফোগতদের চোখের জলও দেখেছে। প্রশ্ন তাই – মানুষ কি ন্যায়বিচার পাবে না?