CATEGORY article:

Card image cap

২৩ মার্চ ভগৎ সিং -এর শহীদ দিবস

২৩ শেষ মার্চ ১৯৩১ বেলা ১১টা, জেলের মধ্যে শেষবারের মতো পরিবারের সাথে দেখা হল ভগৎ সিং এর। ফাঁসির দিন ঠিক ছিলো ১৯৩১ সালের ২৪শে মার্চ। সেইমতো জেলের মধ্যেই ভগৎ সিং এর আত্মীয়রা দেখা করতে এসেছে। একে একে এগিয়ে এলেন বাবা কৃষাণ সিং, দিদি অমর কউর, দুই ভাই - কুলবির ও কুলতার। সবশেষে দেখা হল মা ও ছেলের। বিদ্যাবতী দেবী লোহার গারোদের ফাঁক দিয়ে ভগৎ সিং এর সারা গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে অশ্রু সজল কণ্ঠে বললেন- "ভগনওয়ালা ! কিছুতেই তোমার আদর্শ বিসর্জন দিওনা। মনে রেখো, একদিন না একদিন সকলকেই মরতে হবে। কিন্তু যে মৃত্যু দুনিয়ার মানুষকে নাড়া দিয়ে যায় সেই মৃত্যু তো সব থেকে মহান। আমি এইভেবে গর্বিত যে একটা বড় ও মহান আদর্শের জন্য আমার 'ভগনওয়ালা' আত্মোৎসর্গ করেছে, আমি ভগৎ সিং -এর মা। তোমার কাছে আমার একটাই কেবল ভিক্ষা আছে। আমি চাই আমার ছেলে ফাঁসির দড়ি গলায় নিয়ে দীপ্ত কণ্ঠে বলবে 'ইনকিলাব জিন্দাবাদ'। আমার ছেলের ওজন ফাঁসির আদেশ শুনে বেড়ে যাবে কমবে না।" - ভগৎ সিং হাসিমুখে উত্তর দিয়েছিলেন - "তুমি যা বলছ তাই হবে মা"। যদিও সকলের অগোচরে ভগৎ সিং এর ফাঁসির দিন এগিয়ে এনেছিল ব্রিটিশ সরকার। কারণটি সংক্ষেপে এই রকম- ১৯৩১ সালের ২৪ শে মার্চ করাচীতে জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশন বসার কথা ছিল। ইতিমধ্যেই দেশের অভ্যন্তরে প্রবল দাবি উঠেছে এই মহান বিপ্লবীদের ফাঁসির রদ করবার জন্য বড়লাট লর্ড আরউইনের সাথে দেখা করুক গান্ধীজি। সুভাষচন্দ্র সদ্য জেল থেকে মুক্তি পেয়ে গান্ধীজিকে একান্তভাবে একই অনুরোধ করেছেন। সুভাষচন্দ্র সহ অনেক দেশ নেতাদের বক্তব্য গান্ধী-আরউইন চুক্তির অন্যতম শর্তই হোক এই বিপ্লবীদের মুক্তি।গান্ধীজী বড়লাটের সাথে দেখা করলেন অনেক বিষয়ের মাঝে এ বিষয়টি স্পষ্টভাবে তিনি বড় লাটকে বললেন না। উল্টে তিনি বললেন ওই দিন করাচীতে কংগ্রেসের অধিবেশন, ওই একই দিনে যেন ভগৎ সিংদের ফাঁসি না দেওয়া হয়। গান্ধীজীর এই সাক্ষাতের পর দেশবাসীর আশা ছিল ভগত সিং সহ বিপ্লবীরা মুক্তি পাবে। কিন্তু ঘটলো ঠিক উল্টো, ব্রিটিশ সরকার ফাঁসির দিন পরিবর্তন করে ২৩ শে মার্চ ঠিক করল। এই সিদ্ধান্ত ভগৎ সিং দের সরকারি ভাবে জানানো হলো ২৩ শে মার্চ বিকেল পাঁচটার পরে। প্রস্তুত হও। আর মাত্র আড়াই ঘন্টা। - আড়াই ঘণ্টা কেন এখনই নিয়ে চলো না ! আমরা তো প্রস্তুত আছি সহাস্যে বলেছিলেন ভগৎ সিং। সাধারণত ফাঁসির দন্ডাদেশ কার্যকর করা হতো ভোর বেলায়। সেই প্রথা ভেঙে সন্ধ্যেবেলায় ভগৎ সিং, রাজগুরু এবং শুকদেব কে নিয়ে আসা হল ফাঁসির মঞ্চের সামনে। সেই শেষের সময়টা কিভাবে কাটিয়েছিলেন বিপ্লবীরা? মাকে দেওয়া কথা ভগৎ সিং রাখতে পেরেছিলেন? সন্ধ্যা ৭:২২ মিনিটে তিন জন মিছিল করে যাত্রা শুরু করলেন ফাঁসির মঞ্চের দিকে। ডাইনে রাজগুরু, মাঝে ভগত সিং এবং বামে সুকদেব। তারা উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করলেন 'বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক' - 'ইনকিলাব জিন্দাবাদ'। - হতচকিত হয়ে পড়ল জেলের কয়দিরা। তারা বুঝতে পারল বিপ্লবীরা চলেছে বধ্যভূমির দিকে। জেলে আটক সমস্ত বিপ্লবীরা ভগৎ সিং এর সাথে গলা মিলিয়ে জানান দিল ইনকিলাব জিন্দাবাদ। জেলের অপর সমস্ত কয়েদিরাও একইভাবে উচ্চ কন্ঠের স্লোগানে মুখরিত করে তুললো জেলের আকাশ বাতাস। তখন জেলে শোনা যাচ্ছে একটাই সুউচ্চ কণ্ঠস্বর ইনকিলাব জিন্দাবাদ - বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক। - সেই চরম মুহূর্তে ভগত সিং পরিহাস করে ডেপুটি কমিশনার কে লক্ষ্য করে বললেন- 'ইউ আর ভেরি লাকি'। - উত্তরে ডেপুটি কমিশনার বলেছিলেন- হুয়াই ? - আজ তুমি দেখতে পাবে ভারতের বিপ্লবীরা আদর্শের জন্য কিভাবে হাসিমুখে মৃত্যুবরণ করতে পারে। তারপর তারা এগিয়ে গেলেন বদ্ধভূমির দিকে - মুখের কালো কাপড় ছুড়ে ফেলে দিয়ে হাসিমুখে সেই দড়িকে চুম্বন করলেন। ভগৎ সিং বলেছিলেন - "সুন্দর এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা আমার ছিল একথা গোপন করতে আমি চাইনা। কিন্তু আমার বেঁচে থাকার একটি শর্ত আছে। কারারুদ্ধ, শৃঙ্খলিত জীবন আমি বহন করতে ইচ্ছুক নই।... আজ আমি সানন্দে, হাসিমুখে এমনভাবে ফাঁসির রজ্জুকে বরণ করতে চাই, যা দেখে ভারতের ঘরে ঘরে মায়েরা প্রার্থনা করবে তাদের সন্তান যেন ভগৎ সিং এর মত হয়ে ওঠে। আমার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে দেশের স্বাধীনতা বেদি মূলে আত্মদান করতে এত বিপুলসংখ্যক মানুষ এগিয়ে আসবে যে সাম্রাজ্যবাদ তার সমস্ত দুষ্ট শক্তি প্রয়োগ করেও বিপ্লবের অগ্রগতিকে রুখতে পারবে না।" তথাকথিত ব্রিটিশ সিংহের ভয় ছিল ভগৎ সিং দের মৃত দেহ কেও। তাই পরিজনদের হাতে তা তুলে না দিয়ে রাতের অন্ধকারে লোক চক্ষু আড়ালে শতদ্রু নদীর তীরে পেট্রোল ঢেলে জ্বালিয়ে দেওয়া হয় তাদের মৃতদেহ। দেশমাতৃকাকে স্বাধীন করতে ফাঁসির মঞ্চে প্রাণ বিসর্জন সেই সময়ে এদেশে স্বাভাবিক ঘটনা ছিল। এই দামাল ছেলেদের দেখেই কবি বলেছিলেন- উদয়ের পথে শুনি কার বাণী, "ভয় নাই, ওরে ভয় নাই- নিঃশেষে প্রাণ কে করিবে দান ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।'' এদেশের তরুণ প্রজন্মের এই বাণীকে সত্য প্রমাণ করতে এতোটুকু পা কাঁপেন। কিন্তু শহীদ-ই- আজম ভগত সিংয়ের ফাঁসির ঘটনাকে কেন্দ্র করে সেদিন সারাদেশে প্রচন্ড বিক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছিল - যা ইতিপূর্বে এত ব্যাপক আকারে লক্ষ্য করা যায়নি। এই বিক্ষোভের আঁচ থেকে গান্ধীজি ও রেহাই পাননি সেদিন। ব্রিটিশ সরকারের শত চেষ্টা সত্ত্বেও ২৪ শে মার্চ শতদ্রু নদী তীরে লক্ষ মানুষ সমবেত হয়, বীর শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে। তারা শহীদ ভগত সিং, রাজগুরু, শুকদেবের নামে জয়ধ্বনি দিয়ে মিছিল সংগঠিত করে। একটা ধুমকেতুর মতো ভগৎ সিং ভারতবর্ষের রাজনৈতিক আঙ্গিনায় আবির্ভূত হয়েছিলেন। মাত্র ২৪ বছর বয়সে তার ফাঁসি হয়। কিন্তু কোটি কোটি দেশবাসীর দৃষ্টি ছিল তার উপরে নিবন্ধ। ভগৎ সিং তাদের সামনে হাজির করেছিলেন স্বাধীনতার ভিন্ন এক দিক নির্দেশ।

Card image cap

স্বাধীনতা সংগ্রামী শহীদ সুখদেব থাপার

ভগৎ সিং এর নাম উচ্চারিত হলে তাঁর নামটাও চলে আসে।দুজন দুই রাজ্যে জন্মেছিলেন। বলতে চাইছি সুখদেব এর কথা ।সুখদেব থাপার। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে মুষ্টিমেয় যে কজন নিঃশব্দে ফাঁসির দড়িকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তাদের মধ্যে অন্যতম সুখদেব।মৃত্যুর পূর্বমুহুর্তে ভগত সিং এর সাথে গলা মিলিয়ে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে আওয়াজ তুলেছিলেন “ইনকিলাব জিন্দাবাদ"। বর্তমান প্রজন্মের সাথে পরিচয় ঘটাতেই এ লেখার অবতারণা। সুখদেব থাপার ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামী ও ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের একজন শহিদ। তিনি শহীদ ভগৎ সিংহের এক অনন্য বন্ধু হিসাবেও পরিচিত। বিপ্লবী সুখদেব জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৯০৫ সালের ১৫ মে পাঞ্জাবের লুধিয়ানা শহরে। সুখদেবের বাবার নাম ছিল শ্রী রামলাল থাপার। তাঁর জন্মের তিন মাসে আগেই তাঁর পিতার মৃত্যু হয়।সুখদেবের লালন পালন তার কাকা শ্রী অচিন্তরাম থাপার-এর কাছেই হয়। সুখদেবের জন্মের সময় তার কাকা অচিন্ত্যরাম জেলে সাজা খাটছিলেন। এক বিপ্লবী বাতাবরণে সুখদেব বড়ো হচ্ছিলেন। সুখদেব যখন তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র , গভর্নর তার বিদ্যালয়ে আসে। প্রধান শিক্ষকের আদেশে ছাত্ররা সবাই গভর্নর কে স্যালুট করে, কিন্তু সুখদেব তা করেনি। তখন সুখদেবকে জিজ্ঞাসা করা হল কেন সে গভর্নরকে স্যালুট করল না, সুখদেব পরিষ্কার বলে দিল, সে কোনো ইংরেজকে স্যালুট করবে না। ১৯২৮ সালের ৮ অগাস্ট প্রতিষ্ঠিত হয় “হিন্দুস্তান সোসালিস্ট রিপাবলিকান আর্মি(HRSA)।সুখদেব ছিলেন এই দলের পাঞ্জাব শাখার প্রধান কর্মকর্তা। এখানেই তাঁর সাথে ভগত সিং এর আলাপ ও ঘনিষ্ঠতা হয়। ভগৎ সিং এর তুলনায় সুখদেব পড়াশুনা কম করতো। কিন্তু তাঁর স্মৃতিশক্তি খুব তীক্ষ্ণ ছিল। বিপ্লবী কাজ পরিচালনার জন্য তাঁরা একটা বাড়ী ভাড়া নিল। দিনের বেলায় বাইরে থাকত আর রাত করে ফিরত। এভাবেই বাড়ির মালিক ও আশপাশের লোকজনের সন্দেহ হলো। এই কারণে সুখদেব নিজের মাকে সেই বাড়িতে নিয়ে এলো। এবার কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে, সে উত্তর দিত সে কাজ করে, অনেক দূরে রাস্তার কাজ চলছে। দিন-রাত কাজ করে বাড়ি আসতে দেরি হয়। সুখদেব ছিলেন সাহসী এবং দৃঢ় চিত্তের মানুষ। লাহোরে যখন বোম বানানোর কাজ শুরু হল, তখন সে ফিরোজপুর থেকে বোমের মশলা নিয়ে আসতেন। একবার মশলা আনতে গিয়ে সিপাহীদের খপ্পরে পড়ে গেছিল। এর ফলে সুখদেবকে অনেক মার খেতে হয়েছে। সুখদেব চুপচাপ মার খেতে থাকে, কিন্তু কিছু বলেননি, কারণ তার কাছে পিস্তল, কার্তুজ আর বোম বানানোর মশলা ছিল। ১৯২৮ সালে সাইমন কমিশনের বিরোধিতা করতে গিয়ে লাঠিচার্জে লালা লাজপত রায় মারা যান, তখন সুখদেবরা লালা লাজপত রায় এর হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯২৮ সালের ১৭ ডিসেম্বর ভগৎ সিং,শুকদেব ও রাজগুরু ভুলবশত পুলিশ সুপারিন্টেনডেন্ট স্যান্ডার্সকে হত্যা করেন। এই ঘটনাটি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল ।এই ঘটনার কয়েকমাস পর ভগৎ সিং,শুকদেব ও রাজগুরু গ্রেপ্তার হন। স্যান্ডার্স হত্যার মামলাটি 'লাহোর ষড়যন্ত্র' নামে পরিচিত। বিচারে ভগৎ সিং, সুখদেব ও রাজগুরু কে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ১৯৩১ সালের ২৩ শে মার্চ, বিপ্লবীরা ফাঁসি এই তিন বিপ্লবীর ফাঁসী হয়। ফাঁসির সময় সুখদেবের বয়স ছিল মাত্র ছাব্বিশ বছর।লাহোর কারাগারে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার পরে শিবরাম রাজগুরু, ভগত সিং এবং সুখদেব থাপারের মরদেহ চরম গোপনীয়তায় দাহ করা হয়। ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য আত্মাহুতি দেওয়া এই তিনজন বীর শহীদের স্মৃতিসৌধ ভারতের পাঞ্জাবের ফিরোজপুর জেলার শতদ্রু নদীর তীরে হুসেইনিওয়ালা গ্রামে অবস্থিত। প্রতি বছর ২৩ শে মার্চ তাঁদের মৃত্যুর দিনটিকে স্মরণে রেখে শ্রদ্ধার সাথে "শহীদ দিবস" উদযাপিত হয়।