কম্পাস পত্রিকা

গ্রেটা থুনবার্গ

Published on: 2024-03-21 12:32:49

Share on:

‘'গত ৩০ বছর ধরে বিজ্ঞানের কাছে বিষয়টি একদম পরিস্কার। কিন্তু হাউ ডেয়ার ইউ? কোন স্পর্ধায় আপনারা দেখেও না দেখার ভান করছেন? আমার তো এখানে থাকার কথা নয়। আমার তো স্কুলে থাকার কথা। অথচ আপনারা আমাদের ইয়ং ছেলেমেয়েদের কাছে আসছেন আশা দেখানোর জন্য? আপনারা আমাদের স্বপ্ন চুরি করেছেন। আমাদের ছোটবেলা চুরি করেছেন। মানুষ মারা যাচ্ছে। পুরো ইকো সিস্টেম ধ্বসে পড়ছে। আমরা এক মহাবিলুপ্তির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। আর আপনারা কথা বলছেন টাকা নিয়ে, রূপকথার সাম্রাজ্য নিয়ে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সমস্ত চোখ আপনাদের দিকে। আর আপনারা যদি আমাদের স্বপ্ন চুরমার করে দেন আমি কথা দিচ্ছি আমরা কেউ আপনাদের ক্ষমা করব না।ক্সক্স নিউইয়র্কে রাষ্ট্রসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত সম্মেলনের মঞ্চে এই কথাগুলোই বলেছিলেন বছর ষোলোর কিশোরীটি। সেটা ছিল ২০১৮ সালের ডিসেম্বর। তারপর ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে দাভোসে আয়োজিত ‘ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরামক্স-এর মঞ্চে আরও একবার এই অকুতোভয় ছোট্ট মেয়েটি রাষ্ট্রনেতাদের চোখে চোখ রেখে জানিয়ে এসেছিলেন, ‘‘মুখে বড় বড় কথা নয়, এই পৃথিবীকে ‘শিশুর বাসযোগ্যক্স করে যেতে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে রাষ্ট্রনেতাদের। না হলে অদূর ভবিষ্যতে গোটা মানবসভ্যতাই সংকটের মধ্যে পড়ে যাবে। ভবিষ্যতের বিষয়ে যত্নবান হওয়ার জন্য রাষ্ট্রনেতাদের কাছে আর্জি জানাতে আসিনি আমরা। অতীতেও ওঁরা আমাদের উপেক্ষা করেছিলেন। এবারও তাঁরা সেটাই করবেন। আমরা এখানে তাঁদের এটাই বলতে এসেছি যে, পরিবর্তন আসছে। তা তাঁদের পছন্দ হোক, বা না হোক।ক্সক্স শুধু যে সেখানে দাঁড়িয়েই গ্রেটা আলটপকা কথা বলে ফেললেন তা একেবারেই নয়; এর প্রস্তুতি বহু আগে থেকেই। গ্রেটা থুনবার্গ সুইডেনের একজন স্কুল-শিক্ষার্থী। মাত্র ১৫ বছর বয়সে গ্রেটা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় অবিলম্বে কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করার জন্য আন্দোলনে নামেন। ২০১৮ সালে গ্রেটা স্কুল যাওয়া বন্ধ করে দেন এবং জলবায়ু পরিবর্তন রোধে জরুরি পদক্ষেপের দাবিতে সুইডিশ পার্লামেন্টের সামনে একাই প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে যান। তারপরই স্টকহোমের অন্যান্য শিক্ষার্থীরাও গ্রেটার সঙ্গে যোগ দিতে থাকে। তারা সম্মিলিতভাবে শুক্রবারকে ঘোষণা করে ‘ফ্রাইডে ফর ফিউচারক্স হিসাবে। এই ছেলেমেয়েদের আন্দোলন এখন সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে গিয়েছে। ‘‘আমাদের দেশের মতো ধনী দেশগুলোর ভোগবিলাসের জন্য পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু পৃথিবী জেগে উঠছে, বদল আসছে। সে আপনাদের ভালো লাগুক আর নাই লাগুক।ক্সক্স রাষ্ট্রপুঞ্জের পোডিয়ামে দাঁড়িয়ে বলেন গ্রেটা। গ্রেটা জানেন যে কৃত্রিম উপগ্রহের পাঠানো গত ৫০ বছরের ছবি প্রমাণ করে দিয়েছে সবচেয়ে বেশি অরণ্য ধ্বংস হয়েছে উন্নত দেশগুলিতে। মাত্রাতিরিক্ত কার্বন নির্গমনের জন্য দায়ী উন্নত দেশগুলিই। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে বেশি কষ্ট করছে দরিদ্র দেশের মানুষগুলো। ‘‘আমি আর অপ্রিয় হওয়ার ভয় পাই না। আমার কাছে ক্লাইমেট জাস্টিস মুখ্য। বিজ্ঞানীরা বলছেন, আমরা পৃথিবীর ষষ্ঠ মহাবিলুপ্তির মুখোমুখি। বাস্তুতন্ত্রগুলো ভেঙে পড়ছে। আমরা এক গণবিলুপ্তির মুখোমুখি।ক্সক্স গ্রেটার সতর্কবার্তা। ২০১৯ সালের ১৫ই মার্চ ১১২টি দেশের আনুমানিক ১.৪ মিলিয়ন শিক্ষার্থী তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে জলবায়ু প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করে। বিষয়টি নজরে পড়ে রাষ্ট্রনেতাদেরও। এরপরেই জলবায়ু পরিবর্তনের পরিণতি উপেক্ষা না করার জন্য রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছে আবেদন জানান তিনি। আন্দোলনের বার্তা ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। স্বনামধন্য অনেকেই এই ছোট্ট মেয়েটির আন্দোলনের সমর্থনে এগিয়ে আসেন। গ্রেটা থুনবার্গ তাঁর এই কার্যক্রমের জন্য অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। ২০১৯ সালের মার্চ মাসে নরওয়ের তিনজন সংসদ সদস্য তাঁকে ‘শান্তিতে নোবেল পুরস্কারেরক্স জন্য মনোনীত করেন। মনোনয়নের খবর পেয়ে টুইটারে গ্রেটা লিখেছেন, ‘‘এই মনোনয়নের জন্য আমি সম্মানিত ও কৃতজ্ঞ। আমরা আমাদের ভবিষ্যতের জন্য স্কুল স্ট্রাইক শুরু করেছি; যতদিন করতে হয় ততদিন করে যাব আন্দোলন।ক্সক্স গ্রেটা থুনবার্গ সুইডেনের বাসিন্দা। তাঁর জন্ম ২০০৩ সালের ২ জানুয়ারি। তাঁর পিতা হলেন অভিনেতা স্ভান্তে থুনবার্গ, মাতা মালেনা এরম্যান একজন অপেরা শিল্পী। তাঁর ঠাকুর্দা ওলফ থুনবার্গ একজন অভিনেতা ও পরিচালক। ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে গ্রেটা প্রথম টিইউডিএক্স আলোচনায় বলেন যে তিনি ৮ বছর বয়সে প্রথম জলবায়ু পরিবর্তনের কথা শুনতে পান। কিন্তু তিনি বুঝতে ব্যর্থ হন কেন এই বিষয়ে কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। ১১ বছর বয়সে তিনি হতাশ হয়ে পড়েন এবং কথা বলা একদম বন্ধ করে দেন। পরবর্তীকালে তাকে বেশ কিছুদিন উত্তমরূপে চিকিৎসা করানো হয়। তিনি আলোচনায় বলেন তাঁর ডিসঅর্ডারগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল তিনি যখন প্রয়োজন অনুভব করতেন শুধুমাত্র তখনই কথা বলতেন। তিনি বলেন, ‘‘আমার অনেকটা এমন মনে হচ্ছিল যে আমি যদি এই সম্পর্কে প্রতিবাদ না করি তাহলে ভিতরে ভিতরে মারা যাব।ক্সক্স তাঁর পিতা তাঁর বিদ্যালয়ে যাওয়া বন্ধ করাকে একদম মেনে নিতে পারেননি; কিন্তু তিনি বলেছিলেন, ‘‘আমার মেয়ে ঘরে অখুশিভাবে বসে থাকতে পারে, অথবা যদি চায় তবে সে বাইরে গিয়ে প্রতিবাদও করতে পারে।ক্সক্স অর্থাৎ তিনি তাকে বাধা দেবেন না। গ্রেটা কার্বনের প্রভাব কমাতে তাঁর পরিবারের সকল সদস্যকে বোঝাতে সক্ষম হন ও বিমানে চড়ে ভ্রমণ করাকে বাদ দিতে বলেন। গ্রেটা নিজেও এগুলো করেন না। এত কম বয়সে গ্রেটার নেতৃত্বদানের ক্ষমতা নজর কেড়েছে গোটা বিশ্বের। প্রভাবশালী ‘টাইমক্স ম্যাগাজিনের বিচারে গত বছর কম বয়সী প্রভাবশালীদের তালিকায় ছিলেন তিনি। মূলতঃ শিক্ষার্থী ও যুবদের পরিবেশ রক্ষার কাজে উদ্বুদ্ধ করেন গ্রেটা। পরিবেশ সচেতনতার উদ্দেশ্যে স্কুল ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে আন্দোলনেও নেমেছেন তিনি। পোল্যান্ড ও দাভোস ফোরামে রাষ্ট্রসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনের সম্মেলনে বক্তব্য রাখার পর সারা বিশ্বে অনেক স্কুল পড়ুয়ার জন্য উদাহরণ হয়ে ওঠেন গ্রেটা থুনবার্গ। আমাদের দেশে দিল্লি ও উত্তর ভারতের বায়ু দূষণ এই মুহূর্তে সংবাদ শিরোনামে। সমস্যা শুধু স্বাস্থে্যর নয় সমগ্র অর্থনীতির। সম্প্রীতি ‘নেচারক্স পত্রিকায় প্রকাশিত একটি রিপোর্ট বলছে অত্যাধিক কার্বন-ডাই-অক্সাইড এর ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বিশেষ করে ভারতে অর্থনৈতিক বিকাশ এবং শ্রমের উৎপাদনশীলতা কমে যাচ্ছে। প্রসঙ্গতঃ কানাডা, জার্মানি, নিউজিল্যান্ড বা ব্রিটেনের মত উন্নত দেশগুলিতে প্রতি ইউনিট কার্বন নির্গমনে এই হার মাত্র ০.১% কমবে, কিন্তু উন্নয়নশীল দেশগুলোতে উৎপাদনশীলতার হার কমতে পারে তিন থেকে পাঁচ শতাংশ; বলছেন কনকার্ডিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা। ২০১৮-য় সারা পৃথিবী জুড়ে ৪০ বিলিয়ন মেট্রিক টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গমন হয়েছে, যা থেকে অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে বিশ্ব জিডিপির দুই শতাংশ। তবে বলা হচ্ছে নিম্ন আয়ের দেশগুলিতে এই ক্ষতির পরিমাণ উচ্চ আয়ের দেশগুলি থেকে অন্তত নয় গুণ বেশি হবে! কিন্তু এসব কথা শুনছে কি কেউ? ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকেও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে সতর্ক করেন গ্রেটা। চাঁচাছোলা ভাষায় প্রধানমন্ত্রীর নাম করে তিনি সাফ বলেন, ‘‘প্রিয় মিস্টার মোদি, শুধু আলোচনায় কাজ হবে না। আপনাকে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে।ক্সক্সগ্রেটার এই আন্দোলনের প্রশংসা করেছে ইউ.এন. উইমেন্সও। তাঁরা টুইট করেছেন  সুরক্ষিত ভবিষ্যতের লক্ষ্যে যুব সম্প্রদায়ের কথা শোনাটা যে কত জরুরী সেটা প্রমাণ করেছে ও। তবে খ্যাতির পাশাপাশি বিস্তর সমালোচনাও হচ্ছে গ্রেটাকে নিয়ে। ব্রিটেন এবং অস্টে্রলিয়ার মতো দেশ গ্রেটার এই আন্দোলনের নিন্দা করেছে। সমালোচকদের দাবি পড়াশোনা ছেড়ে এভাবে আন্দোলন করাটা ভুল। ভ্রান্ত নীতির দ্বারা পরিচালিত স্কুল পড়ুয়াদের প্রশংসা করাটাও স্নেহশীলতার আতিশয্য ছাড়া আর কিছুই নয়। যদিও যাবতীয় সমালোচনার উত্তর নিজের চেনা মেজাজেই দিয়েছেন গ্রেটা। বলেছেন, ‘‘যাঁরা আমাদের স্কুলে ফেরত পাঠাতে চান, তাঁদের বলতে চাই কোন পার্থক্য গড়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে আমরা সত্যিই খুব ছোট। কিন্তু আমাদের আন্দোলন প্রতিদিনই কলেবরে বাড়ছে। এই গ্রহে যতটুকু রসদ বেঁচে আছে সেটাই সুষ্ঠুভাবে ব্যবহারের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। আমাদের দাবি একটাই। ভারী ভারী বিজ্ঞানের কথা না বলে সেগুলোকে মন দিয়ে শুনুন। তারপর সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ করুন।ক্সক্স গত আগস্টে গ্রেটা সম্পূর্ণ নবীকরণযোগ্য শক্তিচালিত ইয়টে চড়ে নিউইয়র্ক পাড়ি দেন। কার্বন নিঃসরণ শূন্যের কোঠায় আনতে এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় ব্যক্তিগত উদ্যোগগুলির একটি। উল্লেখযোগ্য এই অভিযান গ্রেটা আয়োজিত এক শুক্রবারের বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদের পর অনুষ্ঠিত হয়। নিউইয়র্কে ডোনাল্ড ট্রাম্পের চোখে চোখ রেখে গ্রেটা তাকিয়েছিলেন - সেই ছবি মুহূর্তে ভাইরাল হয়ে যায়। ট্রাম্প তাঁকে বিদ্রুপ করে একটি টুইট করেন, যার সারমর্ম গ্রেটা একজন হাসিখুশি বাচ্চা মেয়ে (হ্যাপি ইয়ং গার্ল)। অবশ্য তাতে আর কারই বা কী আসে যায়? কিন্তু প্রশ্ন একটা থেকেই যায়। এই হাসিখুশি বাচ্চা মেয়েটা যদি পারেন, আমরা প্রতিবাদ করতে পারছি না কেন? কবে পারবো?!

TOP RELATED